কুফফারদের নিদর্শন ও ভিন্ন জাতির সাদৃশ্য গ্রহনের হুকুম ও মাপকাঠি!

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

মাজাল্লাতুল নাওয়াই আফগান

“শি’য়ার” এর শাব্দিক অর্থঃ চিহ্ণ বা বিশেষ কোন আলামাত।

কুরআন এবং হাদীসের দৃষ্টিতে শে’য়ার: কোন জাতীর এমন বিশেষ নিদর্শনকে বলে যা দেখলেই বুঝে আসে যে এটি অমুক ধর্মের।

আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহঃ বলেন:-

“ শে’য়ারের আলোচনা শুধু ঐ বিষয়গুলোতে হবে যেগুলোর ব্যাপারে শরীয়ত প্রণেতার পক্ষ থেকে কোন বাধা আসেনি। অন্যথায় শরয়ীত কর্তৃক নিষিদ্ধ সকল বিষয় থেকে বেঁচে থাকা তো জরুরী। চাই তা কোন জাতীর নিদর্শন হোক বা না হোক। এছাড়া যে সকল বিষয়গুলোর ব্যাপারে শরীয়তে নিষিদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু তা অন্য কোন জাতীর নিদর্শন তাহলে তা থেকে বেঁচে থাকা মুসলিমদের জন্য জরুরী। যদি তারা বেঁচে না থাকে এবং তাদের নিদর্শনটি অন্যদের মত ব্যাপকতা লাভ করে ।

এমনকি ঐ যুগের নেককার এবং আলেম উলামারাও তা করতে থাকে তাহলে নিষিদ্ধতার কঠোরতা থাকবে না। যেমনঃ শুরুতে ইংরেজদের অনুকরণেই কোট পড়া হতো। অতঃপর তা মুসলমানদের মাঝে ব্যাপকতা লাভ করে। এমনকি পাঞ্জাবের উলামা এবং নেককার লোকেরাও তা ব্যবহার করা শুরু করেছেন।

তাই, যেই নিষেধটা শুরুর গ্রহণ কারীদের জন্য ছিল তা শেষ পর্যন্ত আর বাকি ছিল না এবং হুকুমটাও পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু যে বিষয়গুলো কাফের ও মুশরিকদের মাঝে ধর্মীয় নিদর্শন রুপে প্রচলিত বা যার নিষিদ্ধতা শরীয়ত প্রণেতার পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে তাতে জায়েয বা নম্র হ্ওয়ার হুকুম কখনই দেওয়া যাবে না। ( আনওয়ারুল বারী-৫/১০১)

তাশাব্বুহ বিল কুফফার বা কাফেরদের সাথে সাদৃশ্যতা এর সংজ্ঞা

তাশাব্বুহ এর অনেক সংজ্ঞা আছে। নিম্নে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।

প্রথম সংজ্ঞাঃ নিজের বাস্তবতা, সুরত এবং অস্তিত্বকে ছেড়ে অন্য কোন জাতীর বাস্তবতা, সুরত এবং তাদের অস্তিত্বের মাঝে বিলিন হয়ে যাওয়াকে তাশাব্বুহ বলে।

দ্বিতীয় সংজ্ঞাঃ নিজ সত্ত্বাকে অন্য সত্ত্বার মাঝে নিঃশেষ করার নাম তাশাব্বুহ।

তৃতীয় সংজ্ঞাঃ নিজের আকৃতি ও গঠনকে পরিবর্তন করে অন্য জাতীর আকৃতি ও গঠনকে গ্রহণ করার নাম তাশাব্বুহ।

চতুর্থ সংজ্ঞাঃ নিরেজ বিশেষ বৈশিষ্ট্যাবলী ছেড়ে অন্য কোন জাতীর বিশেষ বৈশিষ্ট্যাবলী গ্রহণ করার নাম তাশাব্বুহ।

পঞ্চম সংজ্ঞাঃ নিজের এবং নিজেদের সীরাত এবং সুরতকে ছেড়ে অন্যদের সীরাত এবং সুরাত গ্রহণ করার নাম তাশাব্বুহ।

এজন্য আমাদের পবিত্র শরীয়ত মুসলিম এবং গায়রে মুসলিমের মাঝে এক বিশেষ ধরণে ভিন্নতা কামনা করে যে, মুসলিম নিজেদের কাঁট-ছাঁট করার ক্ষেত্রে, বসবাস এবং চাল-চলনে অমুসলিমদের উপর বিজয়ী থাকবে এবং তাদের থেকে ভিন্ন হবে।

তাদের থেকে ভিন্নভাবে মুসলমানদের ইবাদাত এবং মুয়ামালাত ও মুয়াশারাত হবে। এই ভিন্নতার বাহ্যিক আলামাত হচ্ছে দাঁড়ি এবং পোশাক ইত্যাদি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। লেবাস হচ্ছে বাহ্যিক এবং বহিরাগত আলামত। স্বয়ং ব্যক্তির দেহের মাঝেই দাঁড়ি ও খাতনার মাধ্যমে পরিবর্তন করে দিয়েছে।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভিবিন্ন স্থানে নিজ সাথীদেরকে অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্যতা অবলম্বন করতে নিষেধ করেছেন।

আল্লাহ তায়ালা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লালালা এর মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মাদিয়াকে অমুসলিম কাফের, ইহুদী এবং নাসারাদের থেকে দূরে থাকার জন্য বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা করেছেন এবং উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ ۘ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ [٥:٥١]
হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ كَفَرُوا
হে ঈমাণদারগণ! তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা কাফের হয়েছে।

সুনানে তিরমীজীতে একটি বর্ণনা আছে যাতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

যে ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম ব্যতীত অন্য কোন ধর্মের তাশাব্বুহ অবলম্বন করবে সে আমাদের কেউ হবে না।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,

তোমরা ইহুদী এবং নাসারাদের সাথে সাদৃশ্যতা রেখ না।

সুনানে তিরমীজীতে আরেকটি হাদীস আছে যে, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

“যে অন্য কোন ধর্মের সাদৃশ্যতা অবলম্বন করবে সে আমাদের অন্তর্ভূক্ত নয়। তোমরা ইহুদী এবং খৃষ্টানদের সাদৃশ্যতা গ্রহণ করো না।”

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দীসিনে কেরাম বলেন:- এইই হাদীস দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে তোমরা ইহুদী এবং নাসারাদের কোন কাজেই তাদের সাথে সাদৃশ্যতা অবলম্বন করো না।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

“যে ব্যক্তি অন্য কোন জাতীর সাদৃশ্যতা অবলম্বন করবে সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত হবে।” [সুনানে তিরমীজি]

“সাদৃশ্যতা” ব্যাপক একটি বিষয়। তা কল্যাণকর বিষয়েও হতে পারে আবার অকল্যাণকর বিষয়েও হতে পারে। পরিণতিতে সে কল্যাণ ও অকল্যাণে তাদের সাথেই হবে। (বাযলুল মাজহুদ)

যারা কাফেরদের সাদৃশ্যতা রাখবে ব্যপারে মোল্লা আলী কারী রাহঃ বলেন:

“যে ব্যক্তি কাফের, ফাসেক বা সাদৃশ্যতা রাখবে অথবা সে নেককার এবং সৎ ব্যক্তিদের সাথে সাদৃশ্যতা রাখবে, পোশাক ইত্যাদির ক্ষেত্রে সে গুনাহ এবং নেককাজের ক্ষেত্রে তাদের সাথেই গন্য হবে।” [মিরকাতুল মাফাতিহ]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আরেকটি হাদীস। তিনি বলেনঃ

“আমাদের মাঝে এবং মুশরিকদের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে টুপির উপর পাগড়ী বাধা।”
(অর্থাৎ আমরা টুপির উপর পাগড়ী বাধি এবং মুশরিকরা টুপি ছাড়া পাগড়ী বাধে।) ( সুনানে আবী দাউদ)

“তাশাব্বুহ” এর ব্যাপারে সাহাবী এবং তাবেয়ীদের কথাঃ

হযরত উমর রাঃ এর যমানায় যখন ইসলামী সাম্রাজ্য প্রশস্ত হতে লাগল তখন উমর রাঃ অনেক চিন্তিত ছিলেন যে, মুসলিমরা অনারবীদের সাথে মিশে না জানি আবার ইসলামের কোন বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন করে ফেলে।

তাই তিনি এই আশংকায়, একদিকে মুসলিমদেরকে তা থেকে বেঁচে থাকার তাগিদ দিতেন । অন্যদিকে অমুসলিমদের জন্য বিভিন্ন আইন করে দিয়েছেন।

আবূ উসমান আল হিন্দি রহঃ এর বর্ণনায় আছে যে, তিনি বলেনঃ আমরা উতবা বিন ফারকাদের সাথে আজরবাইজান ছিলাম। আমাদের নিকট উমর রাঃ এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি পৌঁছল। যাতে অনেক দিক নির্দেশনা ছিল।

আর উনার একটি নির্দেশ এটাও ছিল যে,“ তোমরা নিজেরা নিজেকে আহলে কুফর এবং শিরকের লেবাস এবং আকৃতি থেকে দূরে রাখো।” (জামেউল উসূল)

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে উমর রাঃ যা লিখেছিলেন তার সারমর্ম হলোঃ

“ হে মুসলমান! তোমরা লুঙ্গি ও চাদর ( অনারবদের জন্যে ভিন্ন স্টাইলে বানানো) ব্যবহার ছেড়ে দাও এবং জুতা পরিধান করো।…. তোমরা তোমাদের দাদা ইসমাঈল আঃ এর পোশাক (আরবীয় লুঙ্গি এবং চাদর) নিজেদের জন্য আবশ্যক করে নাও। ভোগ-বিলাস এবং অনারবীদের পোশাক এবং তাদের কাঁট-ছাঁট থেকে দূরে থাকো। তোমরা মোটা, খদ্দর এবং পুরাতন পোশাক পরিধান করো।

অন্যদিকে খৃষ্টান ও ইহুদীদেরকে দারুল ইসলামে থাকার জন্য অনেক শর্তারোপ করেছেন। যার মাধ্যমে অনুমান করা যায় যে, তিনি অনেক দৃঢ়তার সাথে ইসলামী সভ্যতার হেফাজত করেছেন।

তাইতো শাম বিজয়ের পর খৃষ্টানদের উপর যে শর্তারোপ করা হয়েছিল তা নিম্নরুপঃ

“ চুক্তি নামায় নিরাপত্তা কামনার পর নিম্নের শর্তাবলী পূর্ণ করার স্বীকারুক্তি ছিল। “আমরা শামের খৃষ্টানরা মুসলিমদেরকে সম্মান করবো। যদি তারা আমাদের মজলিসে বসতে চায় তাহলে আমরা তাদের জন্য মজলিসে জায়গা করে দিবো এবং আমরা কোন দিক থেকে মুসলিমদের সাদৃশ্যতা গ্রহণ করবো না।

পোশাকেও না, পাগড়ীর ক্ষেত্রেও না, জুতা পরিধানের ক্ষেত্রেও না এবং মাথার চুল কামানোর ক্ষেত্রেও নয়। আমরা তাদের মতো কথা বলবো না। মুসলমানদের নাম এবং উপনামও রাখবো না।

আমরা বাহনে যিন লাগাবো না, তরবারী ঝুলিয়ে রাখবো না, কোন ধরণের অস্ত্র তৈরী করবো না এবং তা বহনও করবো না। নিজেদের মহরের উপর আরবী নকশা বসাবো না। মাথার সামনের অংশের চুল কেটে ফেলব। আর যেখানেই থাকি নিজেদের বৈশিষ্ট্যাবলী বজায় রাখবো। গলায় পৈতা ঝুলিয়ে রাখবো।

আমাদের গির্জাগুলোতে ক্রশ উঁচু করে রাখবো না। মুসলিমদের বাজার এবং রাস্তা-ঘাটে আমাদের ধর্মীয় কিতাব প্রচার করবো না। আমরা গির্জায় বাদ্যযন্ত্র একেবারেই আস্তে বাজাবো। আমরা পুরুষদের সাথে আগুন নিয়ে যাব না। ( এই শেষ শর্তটা অগ্নিপূজারীদের সাথে সম্পৃক্ত)।”

আব্দুর রহমান বিন গানাম রাহঃ বলেন-  আমি এই চুক্তিনামা লিখে উমর রাঃ এর সামনে পেশ করলাম। তিনি এই শর্তগুলোর সাথে আরও কিছু শর্ত যোগ করে দিলেনঃ

“ আমরা কোন মুসলিমকে প্রহার করবো না। আমরা এই শর্তগুলোর ভিত্তিতে নিজেদের জন্য এবং নিজেদের ধর্মীয় লোকদের জন্য নিরাপত্তা হাসিল করলাম। আমরা যদি উপরুক্ত শর্তগুলোর কোন একটির বিরোধিতা করি তাহলে আমাদের নিরাপত্তা নষ্ট হয়ে যাবে এবং যেই ব্যবহার ইসলামের দুশমন ও বিরুধীদের সাথে করা হয় তাই আমাদের সাথে করা হবে।”

অন্য একটি রেওয়াত যেটি আল্লামাহ ইবনে কাসীর রহঃ বর্ণনা করেছেন তাতে আরও কিছু অতিরিক্ত শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে:

“আমরা নিজেদের আবাস্থলে নতুন কোন গির্জা বানাবো না। যেই গির্জা নষ্ট হয়ে যাবে তা মেরামত করবো না। যমীনের যে জায়গা মুসলিমদের হবে তা আমরা আবাদ করবো না। কোন মুসলিমকে দিনে কিংবা রাতে কখনোই গির্জায় আসতে বাধা দিব না। নিজেদের গির্জাগুলো মুসাফির এবং পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত রাখবো। তিনদিন পর্যন্ত অবস্থানকারী মুসলিমদের মেহমানদারী করবো।

আমাদের কোন গির্জা মুসলিমদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরী করার ঠিকানা হবে না। মুসলিমদের জন্য কোন ধোকার আশ্রয় হবে না। নিজ সন্তানদেরকে কুরআন শিক্ষা দিব না। কোন শিরকী প্রথা প্রকাশ্যভাবে পালন করবো না। কাউকে শিরকের দাওয়াত দিবো না এবং নিজের কোন আত্নীয়কে ইসলাম গ্রহণে বাধা দিব না।”

উপরুক্ত শর্তাবলীর প্রতি লক্ষ্য করলে বুঝা যায় যে, মুসলিমরা তাদের তাহযীব-তামাদ্দুন হেফাজতের কতো গুরুত্বারোপ করেছিল। কারণ ইসলামে অমুসলিমদের জীবন পদ্ধতি প্রবেশ করা হচ্ছে ইসলামকে মিটিয়ে দেওয়া এবং ইসলামকে নষ্ট করে দেওয়া।

(Visited 159 times, 1 visits today)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen − nine =